বিভ্রান্ত জাতি
এক
ঘটনাঃ ১
গত কুরবানীর ঈদে ক্রিকেটার মুশফিকের একটা ছবি ভাইরাল হয়েছিল, যেখানে কুরবানীর পরে তিনি হাতে রক্তমাখা ছুরি নিয়ে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছেন।
সেই ছবি দেখে, একেকজন ক্যাপশন দিচ্ছে, “একজন সন্ত্রাসী হওয়ার সব গুণ ভাইটির মধ্যে আছে”। আর এর পরে তো সহমত ভাইদের মনমতো অসংখ্য কমেন্ট তো আছেই!
কিন্তু আমার কাছে খুবই সাধারণ একটি ছবি মনে হয়েছে, এমন অনেকের অনেক ছবি আমি দেখেছি, তুলেছি কুরবানীর ঈদে।
অথচ এরাই অনেক রগরগে মারামারির তামিল ছবি দেখে আনন্দ পান!
ঘটনা ২ঃ
কিছুদিন আগেই এক ভদ্র মহিলা নিজের বিয়ের অনুসঠানে মোটরবাইক চালিয়ে হাজির হয়ে পুরো দেশ, জাতি গরম করে ফেলেছিলেন।
নারী পুরুষ হিসাবের জন্য নয়, বিষয় টির অতিরিক্ত লোক দেখানো আর এমন গুরুত্বপূর্ণ দিনে নিজের নিরাপত্তা জনিত কারণে আমার ভালো লাগেনি – কিন্তু অনেকেরই ব্যাপার টা ভালো লেগেছে।
আমার ভালো লাগেনি, আমি কথা বলিনি – যার বিয়ে সে তার মনমতো করেছে, তার আত্বীয় স্বজনের সমস্যা না থাকলে আমার কেন সমস্যা থাকবে?
জীবন তার, সেটা যাপনের সিদ্ধান্ত ও তার!
ঘটনা ৩ঃ
গতকাল এক ভদ্রমহিলা বোরখা পড়ে তার সন্তানের সাথে ক্রিকেট খেলেছেন বলে, অসংখ্য মানুষের খারাপ লেগেছে। অনেকেই এই পোশাক পড়ে ক্রিকেট খেলার বিরোধীতা করেছেন খুব হতাশা নিয়ে এবং বাজে ভাষায়। ব্যাপার টা খুবই দুঃখজনক।
অথচ এদেরই অনেকে বলেন, মানুষের ধর্ম পালন – তার পোশাক সবই তার ব্যাক্তিগত ব্যাপার! তো কারো ব্যাক্তিগত ব্যাপারে মাক গলানোটাকে অভদ্রতা বলে!
এই সমাজে কুরবানী করে হাতে ছুরি চাকু নিয়ে ছবি দিলে সন্ত্রাসী হয়ে যাবেন, স্যালোয়ার – কামিজ পড়ে বাইক চালালে বেশ্যা হয়ে যাবেন, বোরখা পরে ক্রিকেট খেললে জংগী হয়ে যাবেন – তাহলে মানুষজন এই সমাজে করবে কি বলতে পারেন?
এই জিনিসগুলো আসলে ” রোগ” নয়, রোগের উপসর্গ!
দুই
ব্রিটিশ মিউজিয়ামে গেলে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে তাদের নিয়ে আসা অসংখ্য জিনিস দেখা যায়; এটা শুধু ব্রিটিশ মিউজিয়াম না – রোমান, ডাচ, পর্তুগীজ, ফ্রেঞ্চ যারাই কখনো পৃথিবী শোষন করেছে, তাদের সবার দেশেই এমন জিনিস আছে।
তারা চুরি করে এনেছে বা লুট করে এনেছে এ নিয়ে পরের প্রজন্ম কে জানাতে তাদের দ্বিধা নেই।
কিন্তু বরাবরই আমার মনে হয়েছে আমরা খুবই দ্বিধাগ্রস্থ, লোভী এবং ছোট চিন্তার বড় জাজমেন্টাল জাতি।
আমাদের সমাজের দৈনন্দিন কাজকর্মে ধর্মের বালাই নেই অথচ সবাই সবকিছু যার যার ধর্মের মাপকাঠিতে সবকিছু মাপতে যাই।
আমাদের মধ্যে দেশের প্রেমের দ ও নেই অথচ কথায় কথায় আমরা দেশ ও জাতির বড় ইজারাদার হয়ে যাই।
নারী পুরুষ তো বাদ মানুষ হিসাবেই কোন মূল্যহীন সমাজে আমরা নারীবাদী – পুরুষবাদীর খেলায় মাতি।।
এই সমাজে স্কার্ট জিন্স পড়া মেয়েও রক্ষা পায়না – শাড়ী বোরখা পড়া মা ও রক্ষা পায়না;
এই সমাজে শর্টস পড়া বয়স্ক বাবাও রেহাই পায়না – পাজামা পাঞ্জাবী পড়া ছেলেও মতো মসজিদ মাদ্রাসায় রেহাই পায় না;
এই সমাজের সহনশীলতা এত অল্প যে, আপ্নি বৃত্তের বাহির থেকে দেখেলে বড় ধরনের হোচট খাবেন!
তিন
আমরা মানুষ কে বিচার করছি তার পোশাক দিয়ে, এটা যে কত বড় মানসিক দৈনতা তা তো শেখ সাদী ই দেখিয়ে গিয়েছেন সেই কত কত বছর আগে!
তারপর ও আমরা কিছু শিখিনি, কারণ আমরা শুধু তার খাবার জামার পকেটে রাখার কৌতুক টুকু শুনে হেসেছি, আসল জায়গাটুকু বাদ দিয়েছি।
আমরা এমনি, যার যেখান থেকে যতটুকু নিলে কাজ হবে, নিজেকে মহান রেখে অন্যকে বিচার করা যাবে ঠিক ততটুকু ই নেই।
আমরা টুকরো হয়ে গিয়েছে – ধর্মভেদে, ধর্মের পোশাক ভেদে, আচার ভেদে, রীতিনীতি ভেদে, জাতীয়তাভেদে, রাজনীতিভেদে, লিংগভেদে, আর্থিক সংগতি ভেদে ; যার সবগুলো ই মূলত একটি অশিক্ষিত জনগোসঠীর পরিচয় বহন করে।
শিক্ষা এই জাতির জীবন থেকে যতটাই দুরে সরে যাচ্ছে, আমাদের আচরণে ততই এসব জিনিসগুলো পরিলক্ষিত হচ্ছে। এমনকি শিক্ষিত মানুষজন ও এখন স্রোতে গা ভাসিয়ে দিচ্ছেন, যা নিঃসন্দেহে একটি ভয়াবহ সংবাদ।
এখনো সময় আছে “জাতির মেরুদণ্ড” শক্ত করার ব্যবস্থা শীঘ্রই করা না হলে, এই জাতি কে ভবিষ্যতে বিশ্বের দরবারে চলতে হবে কুঁজো হয়ে অথবা গড়িয়ে গড়িয়ে, আর অবশ্যই এর ঘাটে তখন সিন্দাবাদের ভুত হবে বিশাল দ্বিধাগ্রস্ত, লোভী এবং জাজমেন্টাল জনগোসঠী!!
লেখক: মামুনুর রশীদ,লন্ডন ।